আশা জাগিয়েও পারলেন না বাকী
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস উচ্ছ্বসিত অলিম্পিক শ্যুটিং রেঞ্জে বাংলাদেশের আব্দুল্লাহেল বাকীকে অংশ নিতে দেখে। স্কোরটা তাঁর কাছে গৌণ। কিন্তু ১০ মিটার এয়ার রাইফেল কোয়ালিফিকেশন থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশি শ্যুটারের চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা। নিজের সেরা টাইমিংটাও যে ছুঁতে পারেননি, ৬২১.২ স্কোর করে বাছাইয়ে ৫০ জনের মধ্যে ২৫তম হওয়ায় তাঁর রিও অলিম্পিকই শেষ হয়ে গেল প্রথম দিনে।
‘আমি হতাশ। ভাবিনি এতটা খারাপ হবে। গতকাল (রবিবার) প্র্যাকটিসেও ৬২৬-৬২৭ স্কোর করেছিলাম। কিন্তু আজ...’, দেওদোরে শ্যুটিং এরেনার বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন আব্দুল্লাহেল বাকী। আক্ষেপের কারণ দুটি। প্রথমত পদকের লড়াইয়ে কোয়ালিফাই না করতে পারা। দ্বিতীয়ত নিজের সেরা টাইমিং (৬২৪.৮) ছুঁতে না পারার হতাশা অলিম্পিকে অংশগ্রহণের উচ্ছ্বাসও ভুলতে দিচ্ছে না বাকীকে, ‘অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার পর আর ওটা নিয়ে ভাবিনি। চিন্তা ছিল কিভাবে নিজের সেরা টাইমিংটা করা যায়। আমার সব মনোযোগ ছিল এটাই। এটা অলিম্পিক নাকি অন্য কোনো প্রতিযোগিতা—সেটা ভাবিনি।’ স্কোরবোর্ডে শুরুর অনেকটা সময় ওপরের দিকে থাকার বিষয়টি স্নায়ুচাপে ফেলে দিয়েছিল কি না, তেমনটা মনে করেন না বাকি, ‘স্কোরবোর্ড তো আমার পেছনে। তাই আমার অবস্থান কোথায়, সেটি দেখার সুযোগ ছিল না। নজর রাখছিলাম নিজের প্রতিটা শটের দিকে।’ নিজের সেরা স্কোর দিয়েও অবশ্য পদকের লড়াইয়ে নামা হতো না বাকীর। শীর্ষ যে আটজন পৌঁছেছেন চূড়ান্ত লড়াইয়ে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম স্কোরটাও ৬২৫.৫। শ্যুটিংয়ে এই ০.৭ ব্যবধানও কিন্তু অনেক। গত অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ন ভারতের অভিনব বিন্দ্রা সপ্তম হয়েছেন ৬২৫.৭ স্কোর করে। শীর্ষে থেকে মূল আসরে গেছেন ইতালির নিকোলো ক্যাম্প্রিয়ানি।
তবে অলিম্পিক রোমাঞ্চ কিংবা অন্য প্রতিযোগী ফেলে সব মনোযোগ নিজের নৈপুণ্যেই ছিল বাকীর। তাতে বোঝা যায় কোচ ক্রিস্টিয়েনসেন শিষ্যের মনোজগৎ নিয়েও কাজ করেছেন। অলিম্পিক রোমাঞ্চের সংক্রমণ থেকে বাকীর মনকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন এ ডেনিশ। কিন্তু সেই চাপই কি শুরুতে শীর্ষ পাঁচে ঘোরাঘুরি করা বাকীকে পিছলে নিয়ে গেল ২৫ নম্বরে? বাকী অবশ্য চাপে ভেঙে পড়া কিংবা ক্লান্তি, কোনোটাকেই দায়ী করছেন না, ‘মনঃসংযোগের অভাব নাকি অন্য কিছু, আমি আসলে বলতে পারব না কেন এমনটা হলো। প্রথম ৫০ মিনিট পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই হচ্ছিল। এর পরই সব...’
১০৫ মিনিটের বাছাই পর্বের বাকি অংশে প্রায় প্রতিটি শটেই পিছিয়েছেন বাকী। আর তাতেই এলোমেলো হয়ে যায় সব সম্ভাবনা। মূল মিডিয়া সেন্টার থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ঘেরা দেওদোর শ্যুটিং এরেনার এমনই সৌন্দর্য যে অনায়াসে সিনেমার শ্যুটিংও করে ফেলা যায়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে মাস কয়েক আগে এ ভেন্যু ঘুরেও গিয়েছিলেন বাকী। চেনা রেঞ্জও কেন এত অচেনা মনে হলো তাঁর, ‘একবার দেখে গিয়েছি। তবে চীন-কোরিয়ার অনেক নামিদামি শ্যুটাররা দিন বিশেক আগে এখানে এসেছে। আরো আগে এখানে আসতে পারলে হয়তো ভালো হতো।’
আগে এলে রেঞ্জটার সঙ্গে চেনাজানা আরেকটু ভালো হতো। তবু একটা প্রশ্ন উঠছেই, আগের দিনের প্র্যাকটিসের স্কোরটা মূল আসরে টেনে নিয়ে আসতে পারলেন না কেন বাকী? শেষ ৪৫ মিনিটে ক্রমাগত অবনতির ব্যাখ্যা একটাই—শ্যুটিংয়ে সাফল্যের অনিবার্য মনঃসংযোগটা অলিম্পিক পর্যায়ে নেই তাঁর। শেষদিকে প্রায় প্রতিবার ট্রিগারে চাপ দেওয়ার পরই বিরতি নিচ্ছিলেন বাকী। কারণ, ‘একটা শট খারাপ হলে কিছুটা বিরতি সবাই-ই নেয়’, শেষ মিনিট পনেরোয় তাঁর ঘন ঘন বিরতি আর শরীরী ভাষাতেই আগাম পড়া যাচ্ছিল কী ঘটতে যাচ্ছে।
আর এমনটা ঘটা অভাবিতও নয়। শ্যুটিং ফেডারেশন বিদেশি কোচ নিয়োগ দিয়েছে বেশি দিন হয়নি। বাংলাদেশের অন্য ক্রীড়াবিদদের মতো তাই বাকীরও সর্বোচ্চ প্রস্তুতিটা হয়নি। আর এ তো শুধু রেঞ্জে একা পড়ে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করা নয়, বড় আসরে নার্ভ ধরে রাখার কঠিনতম পরীক্ষার জন্য চাই নিয়মিত সে মাপের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। বাকীরও সে অনুরোধ ফেডারেশনের কাছে, ‘ফেডারেশন আমার জন্য অনেক করেছে। আমার অনুরোধ থাকবে অলিম্পিকের পরও যেন এই সহায়তা অব্যাহত থাকে। নিয়মিত যেন বিশ্বমানের টুর্নামেন্টগুলোয় অংশগ্রহণের সুযোগ পাই।’ এর কোনো বিকল্পও নেই।
এ সমস্যা অবশ্য একজন বাকীরই নয়, অলিম্পিকে অতীতে অংশ নিয়েছেন, এবার নিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও নেবেন—তাঁদের সবার। খেলার মাঠ নেই, পর্যাপ্ত অনুশীলন সুবিধা নেই, পৃষ্ঠপোষকতা নেই একমাত্র সিদ্দিকুর রহমান ছাড়া আর কোনো প্রতিযোগীরই। অবশ্য সাফল্যের পেছনেই ছুটবে পৃষ্ঠপোষক—একদা ফুটবল এবং বর্তমানে ক্রিকেটের বাইরে সিদ্দিকও যেমন ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে আদায় করে নিয়েছেন স্পন্সরশিপ। কিন্তু সাফল্যের পেছনে ছুটতে ন্যূনতম একটা সরকারি-বেসরকারি সহায়তার ভিত তো লাগে। সেটা কতটুকু মেলে বাংলাদেশে। উদাহরণ দিলেন অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলের শেফ দ্য মিশন লে. জেনারেল (অব.) এ টি এম জহিরুল আলম, ‘আমি ফেন্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। তো, বছরে আমার ফেডারেশন বরাদ্দ পায় আড়াই লাখ টাকা। অথচ একজনের ফেন্সিং সরঞ্জামের দামই এর চেয়ে বেশি।’
তাই বাংলাদেশে ফেন্সিংয়ের ভবিষ্যৎও ‘ফেন্সিং’বন্দি থাকার সম্ভাবনাই বেশি। পরিস্থিতি না বদলালে পরবর্তী অলিম্পিকে এসেও একই হাহাকার শোনাবেন ক্রীড়াবিদরা, উন্নতির পুরনো পন্থা নতুন করে কিছুদিন চর্চিত হবে বিভিন্ন ফোরামে। চার বছরের ব্যবধানে আরেকটি অলিম্পিক আসতে আসতে বিস্তৃত হয়ে যাবে সব চর্চা এবং উদ্যোগের পরিকল্পনা।
‘ওয়াইল্ড কার্ড’ পেতে দৌড়ঝাঁপ আর অংশগ্রহণের আবেগটাই থেকে যাবে বাংলাদেশের একমাত্র এজেন্ডা।
Source Link: https://goo.gl/XYCiqj
Source: Kaler Kantha
Updated Date: 9th March, 2017