নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহস ও প্রেরণা উৎস
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমবায় আন্দোলন ও গ্রাম উন্নয়নে আমার মরহুম পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহয়্যা, মাহাবুব আলম চাষী, বাবু সন্তোষ দাশ, প্রয়াত পি.সি.বর্মন, ডাঃ আবুল কাসেম এম. পি, আজাদি সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, সাংবাদিক ফজলুল রহমান, ননী গোপাল চৌধুরী, প্রফেসর এ.কে.এম. আহমেদ উল্লাহ, ড. এ. এইচ. লতিফি, মনোতোষ দাশ, আনোয়ারুল আজিম (ভোলা মিয়া) প্রমুখের সাথে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এর নাম অনায়াসে এসে যায়। স্বনির্ভর গ্রাম, স্বনির্ভর দেশ গড়তে তাঁরা জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে যুগপৎ ভাবে কাজ করে যান। এদেশের সমবায় আন্দোলনে তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
মুক্তিযুদ্ধে প্রফেসর ইউনুচের অবদান প্রসঙ্গে ইউ এস প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক সমাজ কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত স্মরণীকা ‘গ্রামীণ’ এর ৩২ পৃষ্ঠায় কাজী আশরাফ হোসেন রচিত ‘গ্রামীণ ব্যাংকঃ ইউনূসের চিন্তাধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ (চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রের) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা শোনার পর টেনেসির ন্যাসভিলে অবস্থিত হাতে গোনা যে কয়জন বাঙ্গালীকে পেয়েছেন তাদের সবাইকে নিয়ে (মোট ৬ জন) ২৯ মার্চ এক বৈঠকে বসেন তিনি এবং অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। অনুষ্ঠানে আগত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনই এই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা প্রেক্ষাপটকে আরো বেশী বেশি খোঁজ খবর নেওয়ার উপর জোর দেন । ঠিক তখনই আজকের এই নোবেল বিজয়ী দেশ প্রেমিক মুহাম্মদ ইউনূস দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমি আমার নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে ঘোষণা দিলাম- যারা আমার সাথে হাত মিলাবেন না তারা আমার চোখে পাকিস্থানী, এক কথায় বাংলাদেশের শত্রু । অগাধ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত সকলেই বাংলাদেশের পক্ষ নিল এবং তাৎক্ষণিকভাবেই গঠিত হলো বাংলাদেশী নাগরিক সমিতি (উদ্ধৃতি সেলিনা সিরাজ, শিপ্রা চক্রবর্তী)” । এইভাবে ড. ইউনূসের দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় ।
১৯৭৩ সালের ২৬, ২৭ ও ২৮ শে সেপ্টেম্বর বৃহত্তর চট্টগ্রাম থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি সমূহের ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত এক কৃষি সমবায় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তদানীন্তন কুমিল্লা বি.এ.আর.ডি এর ভাইস চেয়ারম্যান জনাব মাহবুর আলম চাষী। যার সভাপতি ছিলেন প্রফেসর ড. ইউনূস ও সম্পাদক ছিলেন আমার মরহুম পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা। আমার পিতা ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে রাউজান হাটহাজারী নির্বাচনী এলাকায় মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দৈনিক আজাদী সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদের প্রস্তাবক ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধে আমার পিতার সাহসিকতার ও ব্যাপক ভূমিকার জন্য দেশ স্বাধীন হলে নিজ গ্রামের (গুমানমর্দন, হাটহাজারী) সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাঁকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানান ও ২টি স্বর্ণপদক এবং নগদ অর্থ সম্মাননা প্রদান করেন । কৃষি ক্ষেত্রে সমবায়ের মাধ্যমে সবুজ বিল্পবের লক্ষ্যে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে উক্ত ব্যক্তিগণ দিন রাত কাজ করে যান।
ষাটের দশকে তাদের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে নিবিড় চাষাবাদ ইরি, বেরো ধান চাষের প্রবর্তন হয়। পরবর্তীতে এতদাঞ্চলে সমবায়ের মাধ্যমে ‘কানী প্রতি একশ, যার নাম সোনালী শ’ আন্দোলন সফল হয়। প্রফেসর ড. ইউনূসের নাম হাটহাজারী জোবরা গ্রামের তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এক সময় তিনি বন্ধকবিহীন বিনিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্ভব ঘটান। আজ তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। নোবেল বিজয়ী এ মানুষটির নাম এখন উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধায়, প্রগার ভালোবাসা ও গভীর আন্তরিকতায়। দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে তার ব্যাতিক্রমী উদ্ভাবন ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সাফল্য তাঁকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি । আজ তিনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন অসীম সাহস আর যোগ্যতা দিয়ে ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিও ২০১৬ অলিম্পিকের মশাল বহন করেন প্রফেসর ইউনূস। বিপুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ২০০ মিটার হেঁটে দেখালেন আমাদের গর্বের ইউনূস । একহাতে মশাল আর অন্য হাত তুলে তিন আঙ্গুল প্রদর্শন, যার উদ্দেশ্য ছিল ‘তিন শূন্য’র লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ববাসীকে উদ্ধুদ্ধ করা। এ ‘তিন শূন্য’র অর্থ হচ্ছে- সামাজিক ও পরিবেশ লক্ষ্য অর্জনে ‘শূন্য দারিদ্র’, “শূন্য বেকারত্ব’ ও ‘শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণ”। তিনি অলিম্পিকের সকল কর্মসূচিতে একটি সামাজিক মাত্রা যোগ করার জন্য প্রচারনা চালান যা তাঁর ভাষণের মূল বক্তব্যেও প্রতিফলিত হয়। ‘চাকরী নেব না, চাকরী দেব’ ; “মানুষ কোনভাবে বেকার হতে পারে না” তাঁর এসব প্রানজয়ী, কালজয়ী বক্তব্য আমাদের জাগিয়ে তুলে। তিনি আমাদের প্রেরনার বাতিঘর । দেশ গড়ায় বিশ্ব গড়ায় এমন চেতনা এ মুহূর্তে অত্যন্ত প্রয়োজন। সামাজিক ব্যবসার ধারনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর তাঁর সহজ সূত্র বিশ্ববাসীকে আকর্ষিত করেছে। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে আমরাও চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছি সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র (সি.এস.বি.সি.এল)। দৈনিক আজাদী সম্পাদক আলহাজ্ব এম এ মালেক, প্রফেসর সিকান্দার খান, পূর্বদেশ সম্পাদক সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুর, ব্যবসায়ী আমির হুমায়ুন মাহামুদ চৌধুরী, সংগঠক ও কলামিষ্ট শাখাওয়াত হোসেন মজনু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম, চিকিৎসক ও কলামিস্ট ডাঃ কিউ, এম, অহিদুল আলম, শিক্ষাবিদ ড. কামাল, সেতারা গাফফার, কানিজ ফাতেমা মুন্নি, ব্যাংকার মুজিবুল কাদের, এডভোকেট মুহাম্মদ ইদ্রিস প্রমূখ সহ মোট ৩১ জন এর সাথে আমারও সৌভাগ্য হয় উক্ত মহৎ কাজে সম্পৃত্ত হওয়ার । ইতিমধ্যে উক্ত সেন্টার বিপুল সংখ্যক উদ্যোমী যুবককে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সামাজিক ব্যবসায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ড. ইউনূস ভিক্ষাবৃত্তিকেও ঘৃণা করেন । তিনি দান’কে অর্থবহ করে তুলেন তা রিসাইক্লিং- পদ্ধতির মাধ্যমে। সামাজিক ব্যবসায় দানকৃত অর্থ বহুগুণে বার বার ফিরে আসে আরো বেশী বিনিয়োগ শক্তি নিয়ে। আমার মরহুম পিতার এ- ঘনিষ্ট জন মুক্তমনের সহজ সরল চাঁটগাইয়া মানুষটির সান্নিধ্যে যখনি গিয়েছি তখনই কাছে টেনে নিয়ে অন্যবদ্য ভালোবাসা ও হাসির রশ্মিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি। মানুষকে আপন করে নেয়ায় এক যাদুকরি শক্তি তাঁর মাঝে কাজ করে । ইউনূসের নোবেল বিজয়ে সেদিন মনে হয়েছে কোন ব্যক্তি নয় ‘বাংলাদেশ নোবেল পেয়েছে’ । তিনি এদেশের অর্থনীতিকে জোরদার করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে গড়ে তুলতে যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, তা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম । কেননা স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা তাকে রক্ষা করা আরো কঠিন এবং মহান দায়িত্ব । ড. মার্টিন লুথার কিং নিপীড়িত কৃতদাস জাতিগোষ্ঠিকে নিষ্পেষণ মুক্ত করতে ওয়াশিংটনে ১৯৬৪ সালে দেয়া ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতা মানবতার মাইলস্টোন হিসেবে – রূপ পেয়েছে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি নোবেল পেলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গণহত্যার বিরুদ্ধে বক্তৃতার অপরাধে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁকেও হত্যা করা হলো । মুক্ত চিন্তার অপরাধে সক্রেটিসকেও বিষপান করিয়ে হত্যা করছিল ধর্মান্ধরা। তারপরও সক্রেটিস, মার্টিন লুথার আজো জীবিত তাদের মৃত্যু নেই । সিভিল রাইটস এ্যাক্টের ৫৪ বছরের মাথায় হোয়াইট হাউজে কালো প্রেসিডেন্ট । ২ যুগ আগেও সেখানে কালো আর সাদা মানুষের বিস্তর বৈষম্য বা পার্থক্য ছিল । উন্নত বিশ্বে দলমত নির্বিশেষে সকল জাতীয় নেতা ও ব্যক্তিত্বদের সম্মান দেখানোর ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। ফলে তারা বিশ্বের শাসক । নিজের পছন্দের নেতাদের নাম তুলে ধরতে আপত্তি নেই। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ভাষায় বলতে হয় –
একদিন যবে হারিয়ে যাবো
আমার মর্ম বুঝবে,
অস্ত রবির সন্ধ্যা তারায়
আমায় কবর খুঁজবে ।
আসুন আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথোপযুক্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেকে একটি মর্যাদাবান সম্মানিত জাতি ও মুক্ত চিন্তার দেশ হিসেবে পরিচিত ঘটাই ।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিষ্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকার কর্মী।
Source Link: https://goo.gl/zTCj5X
Source: Dainik Purbokone
Updated Date: 9th March, 2017