জাগ্রত দেশের ডুবন্ত দুর্ভাবনা
দেশটা কি কসাইখানা? নাকি কোনো অত্যাচার কেন্দ্র? একদিকে উন্নয়নের এত গালগল্প, উন্নয়নও আছে বৈকি। আরেকদিকে মিডিয়াজুড়ে খালি মারামারি। এই ক’দিন আগে নাসিরনগরে যা ঘটল তার সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা যাই হোক নৈতিক ব্যাখ্যা কিন্তু সাংঘাতিক। পচে যাওয়া সমাজ বা ব্যক্তিকে আপনি যত দামি পোশাক পরান না কেন তার পচন বেরিয়ে পড়বেই। সাম্প্রদায়িকতার মতো ভয়াবহ ব্যাধিকে কিভাবে চোখ বুজে এড়াব আমরা? ঘটনা ঘটিয়েছে কতিপয় অথবা একদল বর্বর মানুষ। কিন্তু মুখ চুন হয়ে গেছে জাতির। শুধু কি তাই? এ ঘটনার ঢেউ আছড়ে পড়েছে নেপালে, ভারতে, বিদেশের বাঙালির প্রতিবাদে। তারপরও আমরা সমানে এড়িয়ে যাচ্ছি বাস্তবতা। আওয়ামী লীগের আমলে ঘটনা ঘটলেও কি এটাই বলতে হবে যে কিছু হয়নি?
খবরে দেখেছি ছয়টি পরিবার নিখোঁজ। এখানে নিখোঁজ মানে তারা পালিয়ে গেছে। মারা যায়নি। কোনো নদীতে লাশ হয়ে ভেসে ওঠার আগেই জান নিয়ে পালিয়েছে। এখন এই সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা থামছে না। একদল লোক বলছে ওরা তো রাতের আঁধারে প্রতিবেশী দেশে চলে গেছে, জানেন না? ওরা কি সুখে চলে গেছে যে আনন্দে ধেই ধেই নৃত্য করতে করতে যাবে? না তাদের দায় ছিল সবাইকে ডেকে ভাষণ বা ঘোষণা দিয়ে দেশ ছাড়ার? যারা দিনদুপুরে অনিরাপদ যাদের শেষ সম্বল পর্যন্ত দিনের আলোয় লুট হয়ে যায় তারা পালাবে না? খবরে দেখলাম গরিব মা ছেলেকে ঢাকা নটরডেম কলেজে পড়ানোর টাকা জমিয়েছিলেন সেগুলোও নিয়ে গেছে, কি দারুণ! ধর্মের ইজ্জত বাঁচানোর নামে ঝাঁপিয়ে পড়া নরপশুর দল টাকা লুট করতে ভোলেনি। এমন অজস্র হারানো আর কান্নার গল্পে ঠাসা নাসিরনগর। বুঝলাম হিন্দুরা অনিরাপদ। তার দুদিন পর সামাজিক মিডিয়ার ভাইরালে দেখি এক বয়স্ক মানুষকে বেধড়ক পেটাচ্ছে একদল যুবক। হাতে মোটা লাঠি হয়তো অস্ত্রও ছিল। দেখা যায় না এসব ভিডিও। বুক ধড়ফড় করে। কমজোর সিনায় টান লাগে। বয়স্ক মানুষ চায়ের দোকানে এসেছিলেন। প্রকাশ্যে সবার সামনে তাকে এভাবে নির্মম কায়দায় পেটানো? পরে জানলাম তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার অপরাধ নাকি কোনো সংসদ সদস্যের সঙ্গে টেন্ডারে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া। তাহলে টেন্ডারের দরকার কি? বলে দিলেই হতো এ কাজ সংসদ সদস্যরা ছাড়া আর কাউকে দেয়া যাবে না। এটা কি মগের মুল্লুক? নাকি আইনহীন কোনো বর্বর জনপদ? যারা মুক্তিযোদ্ধা বলে ভদ্রলোকের জন্য বিশেষ মায়া দেখাচ্ছেন তাদের দলে নেই আমি। সবার জন্য নিরাপদ হতে হবে এই দেশ। মুক্তিযোদ্ধা বলে মার খাবেন না, বাকিদের মারা জায়েজ এটা কোনো যুক্তিতে টেকে না। তার গায়ে হাত তোলার অপরাধ ডাবল হতে পারে। একে মারধর তাতে মুক্তিযোদ্ধার গায়ে কিন্তু এ জঘন্য হামলা যেন কারো বিরুদ্ধে হতে না পারে তার জন্য আওয়াজ তোলা জরুরি। কি সাংঘাতিক বল আর কি পৈশাচিক দেহভঙ্গী। এরা নাকি আমাদের দেশের যুবক আমাদের সন্তান। কিভাবে কবে আমরা এমন নিষ্ঠুর ও বর্বর হয়ে উঠলাম? একজন নিরীহ মানুষকে সবার সামনে এভাবে মারার মতো অসভ্যতার নাম ডিজিটাল?
কিছুদিন আগে একটা বাচ্চা বা তরুণকেও মারতে দেখেছি। আর একটা তরুণ ছেলে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছিল। এসব ঘটনা যারা ভিডিও করে তারা কারা? তাদের ধৈর্য আর সাহসের তারিফ করতে হয়। এত সময় ধরে একটি নৃশংস ঘটনার ভিডিও ধারণও এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। আগে মানুষ রক্ত দেখলে মূর্ছা যেত। মানুষ মারামারি দেখলে পালাত। পুলিশ ডেকে আনত। এখন ভিডিও ধারণ করে। এর নাম অগ্রগতি? এই রক্তাক্ত স্বদেশ বা পরিবেশ আমাদের আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যারা দেশ শাসনে আছেন তাদের মূল অহঙ্কারের জায়গা নাকি ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব। তাহলে মুক্তিযোদ্ধাকে পেটাচ্ছে কেন সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা? কিসের জোরে? কার যে কোথায় খুঁটি তাও এখন বোঝা ভার। কার বিচার হবে কার হবে না কার শাস্তি হবে কার হবে না কে রিমান্ডে যাবেন আর কে ডিমান্ডে থাকবেন সবকিছুর নিয়ন্তা যদি হয় রাজনীতি বা দল, এমন হতে বাধ্য। আপনি যদি জেনে যান আপনার অপরাধ শাস্তিহীন বা আপনি পার পেয়ে যাবেন তাহলে উন্মাদ হতে বাধা কোথায়?
সমাজের এত অসঙ্গতি অথচ আরেকদিকে চলছে উন্নয়নের ধারা। কি এক ভয়াবহ বাস্তবতা। আমেরিকায় হলো নির্বাচন আর আমরা ভাগ হলাম কয়েক ভাগে। আওয়ামী লীগ ভেতরে যাই থাক ওপরে কিন্তু হিলারিবিরোধী হতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের এই জায়গায় ঠেলে দিয়েছিল ড. ইউনূস ও বিএনপি। একজনের ব্যক্তি আক্রোশ আর একদলের গদি হারানোর প্রতিশোধ। আখেরে ড. ইউনূস নিজেই হারলেন। এ যে মিলিয়ন ডলারের চাঁদা এটা কি খামোখা? এর পেছনে যে চাল বা যে প্রত্যাশা সেটা গোপনীয় কিছু না। এটাও সামাজিক রাজনৈতিক হঠকারিতা। একজন নোবেলজয়ী মানুষ দেশের কোনো কিছুতে কথা বলেন না মার্কিন নির্বাচনে উৎসাহে ফেটে পড়েন। তাহলে কি শিখল দেশের মানুষ? কি জানল তারা?
সবার আগে সরকারকেই সাবধান হতে হবে। সরকারের সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হতে পারে না। বাকিরা কোথাও গিয়ে মালাউন বলবেন কোথাও মানুষকে ভয় দেখাবেন কোথাও নিজেরা নিজেরা মারামারি করবেন আর জনগণ চুপ করে দেখবে এটা ভাবা অন্যায়। বাকি রাজনীতির তো খবরই নেই। কে যে কোথায় কি করছে গোয়েন্দারাও বোধকরি জানে না। এভাবে চললে উন্নয়ন যত বেশি হোক না কেন সমাজ তা ধরে রাখতে পারবে না। সে দিকেই কি চলছে বাংলাদেশ? আমরা হতাশ হতে চাই না। সাধারণ মানুষের যে অগ্রগতি উদ্যম ও আধুনিকতা তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের বিকল্প নেই। সেটা কি আসলে পাব কোনো দিন? সেই পাকিস্তান আমল থেকে সবলের অত্যাচার সাম্প্রদায়িকতা আদিবাসী নির্যাতন যুব সমাজের অধঃপতন ধর্ষণ হত্যার মতো নোংরা পথে পা বাড়িয়েছে। কি করে মুক্ত হবো আমরা? এখনো নাসিরনগরে মহিলাদের ইজ্জতের ভয়ে গলাপানিতে ডুবে থাকতে হলে ডিজিটাল দেশ কি ডুববে না মাথা তুলে বলবে আমি বেঁচে আছি?
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।
Source Link: http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/11/13/116032.php
Source: Daily BhorerKagoj
Updated Date: 9th March, 2017